|
১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনের সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের বলিষ্ঠ ও সাহসী ভূমিকা ছিল। সে সময় এমন ঘটনার আবর্ত সৃষ্টি হয় যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলই তাতে জড়িয়ে পড়েন এবং তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা শাহাদত বরণ করেন।
এরপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিশ্চিহ্ন করার যে ব্যর্থ প্রয়াসের সূচনা করে তাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও আক্রান্ত হয়। কয়েকদিনের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে দল রাজশাহীতে সক্রিয় ছিল তা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অবশেষে স্থানীয় ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। রাজশাহী শহর তৎকালীন ই.পি.আর নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তান সেনাবিহনীর একটি বিপুল অংশ শহরে প্রবেশ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী ঘাটি স্থাপন করে।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবপূর্ণ অবদান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। তাদের বিতাড়িত করতে শাহাদত বরণ করেন গণিত বিভাগের রিডার (সহযোগী অধ্যাপক) অধ্যাপক হবিবুর রহমান, ভাষা (সংস্কৃত) বিভাগের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মীর আবদুল কাইউম, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্র।
এছাড়াও শহীদ হয়েছেন প্রশাসনিক ভবনের নৈশ প্রহরী আবদুর রাজ্জাক, স্টেনো টাইপিস্ট (প্রশাসন) শেখ এমাজউদ্দিন, উচ্চমান সহকারী (হিসাব বিভাগ) এসএম সাইফুল ইসলাম, কর্ম সহযোগী (প্রকৌশল দপ্তর) মো. কলিম উদ্দিন, সুইপার (স্টুয়ার্ড শাখা) মোহনলাল, পরিবহন শাখার ড্রাইভার আবুল আলী, কাঠমিস্ত্রি (প্রকৌশল দপ্তর) শফিকুর রহমান, প্রহরী (স্টুয়ার্ড শাখা) নূরু মিঞা, উপাচার্য অফিসের জরুরি পিয়ন মোহাম্মদ ইউসুফ, পিয়ন (পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তর) মো. ওয়াজেদ আলী, প্রহরী (উপাচার্য দপ্তর) মো. আফজল মৃধা, অর্ডালি পিয়ন (প্রক্টর দপ্তর) ওয়াহাব আলী, বেয়ারা (আইন বিভাগ) আবদুল মালেক।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পর যারা মারা গেছেন শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার কিউরেটর মনছুর আহমদ খান, প্রহরী হোসেন আলী। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের ভূমিকাও কম ছিলনা। তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে গৌরব অর্জন করেছে। শহীদও হয়েছেন বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবদুল মান্নান আখন্দ, বাংলা শেষ বর্ষের ছাত্র আমীরুল হুদা জিন্নাহ, এমএসসি পূর্বভাগের ছাত্র গোলাম সারওয়ার খান সাধন, রসায়ন বিভাগের স্নাতক সম্মান শ্রেণীর ছাত্র প্রদীপ কুমার রাহা, অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ আলী খান, বাণিজ্য বিভাগের স্নাতক সম্মান শ্রেণীর ছাত্র শাহজাহান আলী, পদার্থবিদ্যা বিভাগের এমএসসি (পূর্বভাগ) ছাত্র মিজানুল হক।
স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়ে দেশকে শক্রমুক্ত করে আজো অনেক শিক্ষক-কর্মচারী বেঁচে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। এদের মধ্যে ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর শামসুল আলম (বীর প্রতিক), বিজ্ঞান কারিগরি কারখানার কর্মচারী নেবাল কমাল, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএ) সহকারী রেজিস্ট্রার আবুল কালাম আজাদ, ডেপুটি রেজিস্ট্রার এস এম গোলাম নবী, বাহক মহিয়ার রহমান, ডেপুটি রেজিস্ট্রার (রেজিস্ট্রার দপ্তর) আজহার আলী, সেকশন অফিসার (স্টুয়ার্ড শাখার) মীল গোলাম কিবরিয়া, গার্ড সুপার ভাইজার (স্টুয়ার্ড শাখা) ইলিয়াস হোসেন, প্রহরী ইনাল আলী, গার্ড সুপার ভাইজার (স্টুয়ার্ড শাখা) মোসলেম আলী, কমন বেয়ারা (হবিবুর রহমান হল) মো. আব্দুল হান্নান, সেকশন অফিসার (সোহরাওয়ার্দী হল) শহীদুল্লাহ, ভাষা বিভাগের পিয়ন শহীদুল্লাহ, কাঠমিস্ত্রি (প্রকৌশল দপ্তর) আব্দুস সামাদ, সহকারী ইঞ্জিনিয়ার (প্রকৌশল দপ্তর) বদরুল আলম, ড্রাইভার (পরিবহন দপ্তর) আজিজুল হক।
বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকার আদায়ে ও সুসংগঠিত করতে গঠিত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার কাউন্সিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই মহান আত্মত্যাগ, যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন আর ঐতিহাসিক দলিলপত্র স্মরণীয় আর সংরক্ষণ করে রাখার প্রয়াস হিসাবে ১৯৭৬ সালের ২ জানুয়ারি ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তৎকালীন ভিসি প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসানের সভাপতিত্বে ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন কমিটির সভায় গৃহীত হয় এ সিদ্ধান্ত। কাজ দ্রুত শেষ করে সে বছরেরই ২১ ফেব্রুয়ারি সংগ্রহশালাটি দর্শকদের জন্য প্রথম খুলে দেয়া হয়। ৬ মার্চ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সরকারের তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা আবুল ফজল।
এছাড়া স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখার জন্য ক্যাম্পাসে নির্মিত হয় মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘সাবাস বাংলাদেশ।’ সিনেট ভবনের দক্ষিণে অবস্থিত এ ভাস্কর্যটি ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের উদ্যোগে শিল্পী নিতুন কুণ্ডুর উপস্থাপনায় নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে এর ফলক উন্মোচন করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তৎকালীন সময়ের গণকবরকে স্মৃতি চিহ্ন করে রাখার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে বধ্যভূমি। এটি মূল ক্যাম্পাসে পূর্বদিকে অবস্থিত। সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।
সুত্রঃ বাংলামেইল