|
‘একাডেমিক সুপারভিশন’ নামের ওই অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাত্র ৫৬ ভাগ স্কুল সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারে।
এই পদ্ধতিতে একেবারেই প্রশ্ন করতে পারে না- এমন স্কুল রয়েছে ১৭ ভাগ। বাকি প্রায় ২৭ ভাগ প্রতিষ্ঠান রয়েছে মাঝামাঝি পর্যায়ে। অর্থাৎ ওই সব প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর প্রশ্ন করতে পারেন। যেসব বিষয়ের শিক্ষকরা বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারেননি, স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা নেয়ার জন্য সেসব বিষয়ের প্রশ্ন বাইরে থেকে কিনে নিতে হয় কর্তৃপক্ষকে।
এখানেই শেষ নয়, চলতি বছর সরকার মাধ্যমিক স্তরের গণিত বিষয়টিকেও সৃজনশীল পদ্ধতির অধীনে আনে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে বিষয়টি এতটাই জটিল আকার ধারণ করে যে, বিগত অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় খোদ ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮০ ভাগ ছাত্রছাত্রী ফেল করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সারা দেশে যে সাড়ে ২৭ হাজার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে উচ্চশিক্ষিত, দক্ষ, যোগ্য ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক রয়েছেন রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। সেখানে যদি শিক্ষার্থীদের এই দশা হয়, তাহলে সারা দেশের চিত্র কী তা সহজেই অনুমেয়।
সৃজনশীল পদ্ধতি হবে মূল পাঠ্যবইয়ে যে পাঠ রয়েছে তার থেকে প্রশ্ন না করে তারই মূলভাবের আলোকে বাইরের দৃষ্টান্ত নিয়ে প্রশ্ন করা। সেই দৃষ্টান্ত থেকে জ্ঞানমূলক, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা- এই চারটি স্তরে প্রশ্ন করা হয়।
শিক্ষার্থীরা দৃষ্টান্ত অনুসরণে মূল পাঠ সামনে রেখে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই পদ্ধতিকে ইতিবাচকভাবে দেখে থাকেন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মনে করেন, এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা চিন্তাশীল ও সৃজনশীল হবে। সৃজনশীল পদ্ধতির লেখাপড়াকে বিশিষ্টজনরা ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও শিক্ষকদের পাঠদানের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। নতুন এ পদ্ধতিতে এখনও শিক্ষকদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হয়নি। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়নি। শিক্ষকরা যথাযথভাবে পাঠদান করতে পারছেন না। প্রশ্ন করতে গিয়ে, খাতা মূল্যায়ন করতে গিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। যে কারণে সারা দেশে অন্তত ৯২ লাখ শিক্ষার্থী বিপাকে পড়েছে।
ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক অধিকারভিত্তিক বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে থাকে অভিভাবক সমন্বয় পরিষদ নামে একটি সংগঠন।
সংগঠনটির তথ্য মতে জানা গেছে, অগ্রণী স্কুল, সরকারি ল্যাবরেটরি স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ রাজধানীর শীর্ষ ১০টি স্কুলে জরিপ চালিয়ে তারা দেখেছেন, ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী সৃজনশীল পদ্ধতির বিরোধিতা করছে।
তারা জানান, এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের কাছে রীতিমতো আতঙ্কের বিষয়। তার অভিযোগ, আসলে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের কাছে সৃজনশীল পদ্ধতি শুরু থেকেই এক অজানা আতঙ্ক। বিশেষ করে গণিতের আতঙ্কের বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রী, সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এবং শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের জানিয়েও ফায়দা পাওয়া যায়নি।
তারা সবাই অনেকটা নির্লিপ্ত। তিনি দাবি করেন, সরকার বলছে, কোচিং আর নোট গাইড বন্ধে এই সৃজনশীল পদ্ধতি ভূমিকা রাখছে। কিন্তু বাস্তবে দুটিই বেড়ে গেছে। এখন স্কুলে-বাইরে সব জায়গায় শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হয়। পড়তে হয় প্রাইভেট। আগে একটি কোম্পানির গাইড কিনে চললেও এখন বেশি বেশি উদ্দীপক (দৃষ্টান্ত) পেতে একাধিক কোম্পানির গাইড কিনতে হয়।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় ও ঢাকার মতো একই চিত্র দেখা গেছে।
গাইড কেবল যে শিক্ষার্থীরা কিনছে তা নয়, শিক্ষকরা পর্যন্ত তা দেখে ক্লাসে পাঠদান করেন। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে সরেজমিন পরিদর্শনকালে এ চিত্র পাওয়া গেছে। গাইডের বিক্রি বৃদ্ধির ব্যাপারে দেশের অন্যতম সেরা গাইড পাঞ্জেরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল হাসান শায়ক বলেন, বর্তমান পদ্ধতিতে তারা আসলে গাইড নয়, রেফারেন্স বুক প্রকাশ করেন, যা শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়কে মূল পাঠ বুঝতে সহায়তা করে।
পুঁথিনিলয়ের স্বত্বাধিকারী শ্যামল পাল বলেন, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েই তাদের বই কেনেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কোথাও পেশাদার কোচিং সেন্টার আবার কোথাও মন্ত্রণালয়ের নীতিমালার অপপ্রয়োগ করে দুর্বল শিক্ষার্থীর পরিবর্তে ক্লাসের সবাইকে কোচিং করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে শারীরিক শিক্ষার মতো বিষয় পর্যন্ত কোচিং করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এই দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে।
সেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ১ হাজার করে টাকা দিতে হয় শিক্ষককে, বাধ্যতামূলক কোচিংয়ের জন্য। সংশ্লিষ্টরা জানান, সৃজনশীল পদ্ধতির সফল বাস্তবায়ন না হওয়ার আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ২০১৩ সালের এইচএসসির ফলাফল। এবার উচ্চতর গণিত, রসায়ন আর বাংলার মতো বিষয়ে খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা। এর জন্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অবশ্য বিরোধী দলের পরীক্ষাকালে হরতালকে দায়ী করেন। কিন্তু রসায়ন পরীক্ষার আগের দিন কোনও হরতাল ছিল না। তারপরও সেই বিষয়ে সারা দেশেই শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক বেশি ফেল করেছে।
জোড়াতালির সৃজনশীল: মাউশির একাডেমিক সুপারভিশন রিপোর্টের ২২ পৃষ্ঠায় উপস্থাপিত দেশের ৯টি অঞ্চলে সৃজনশীলের বাস্তবায়ন পদ্ধতির সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকা অঞ্চলে প্রায় ৫৯ ভাগ প্রতিষ্ঠান সৃজনশীলে সম্পূর্ণ প্রশ্ন করতে পারে। ২৭ ভাগের বেশি প্রতিষ্ঠান বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে।
বাকিদের প্রশ্ন প্রণয়নের হার আংশিক। রংপুর অঞ্চলেও প্রায় এই একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গেছে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে বরিশাল। ওই অঞ্চলের প্রায় ৩৫ ভাগ প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ প্রশ্ন নিজেরা করতে পারে। ৪৫ ভাগের বেশি প্রতিষ্ঠান প্রশ্ন আংশিক নিজেরা করে আর ২০ ভাগের বেশি প্রতিষ্ঠান বাইরে থেকে প্রশ্ন কিনে নেয়।